রাতের জাদু ডিকোড! ফায়ারফ্লাই জিন কীভাবে আলো, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে তা বাংলাদেশের সংবাদ অনুসন্ধান করে।
বিজ্ঞানীরা ফায়ারফ্লাই লাইটের জেনেটিক কোড আনলক করে, পরিবেশ বান্ধব আলো এবং বায়োমেডিসিনের দরজা খুলে দেয়। ছবি: দিনক্ষণ২৪.কম |
যুগ যুগ ধরে, জোনাকির রহস্যময় আলো কবিদের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করে এসেছে, প্রেমিক-প্রেমিকাদের মনে রোমান্স জাগিয়েছে, এবং বিজ্ঞানীদের মনে কৌতূহল জাগিয়েছে। অবশেষে, চীনের হুয়াজং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জোনাকির আলোর উৎস উন্মোচন করেছেন, যা টেকসই আলোর নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
জিনগত রহস্যের সমাধান:
গবেষণায় জোনাকির আলো বা 'ফায়ারফ্লাই বায়োলুমিনিসেন্স'-এর পেছনের জিনগত প্রক্রিয়া চিহ্নিত করা হয়েছে। ইলব এবং লুসিন নামক দুটি জিন জোনাকির আলো তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূর্বে ধারণা করা হতো এই জিনগুলো কেবল জোনাকির বিকাশে সহায়তা করে।
জোনাকির দেহে লুসিফেরিন এবং লুসিফেরেজ নামক দুটি রাসায়নিক থাকে। ইলব এবং লুসিন জিন অনুঘটক হিসেবে কাজ করে এই রাসায়নিকগুলোকে একত্রিত করে আলো তৈরি করে। এই আলো জোনাকিদের শিকার, সঙ্গী খুঁজে পেতে এবং বিপদ থেকে সাবধান থাকতে সাহায্য করে।
বিজ্ঞানীরা প্রায় ২০০০ প্রজাতির জোনাকির সন্ধান পেয়েছেন। এরা জাত ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রকমের আলোর ঝলকানি তৈরি করতে পারে। কিছু জোনাকির আলো সবুজ, কিছু হলুদ, কিছু লাল, আবার কিছু নীল।
সঙ্গীর ডাক:
হুয়াজং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী সিনহুয়া ফু বলেন, "ফায়ারফ্লাইগুলোর লার্ভায় আলো তৈরির অঙ্গ দ্রুত সৃষ্টি হয়। প্রাপ্তবয়স্করা এই অঙ্গ বিশেষ উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বিষয়টিকে একটি লণ্ঠনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জোনাকি পোকার আশপাশে কোনো সঙ্গী থাকলে সে মোর্স কোডের মতো আলোক ঝলকানি দেখাতে পারে।"
এই গবেষণা টেকসই আলো উন্নয়নের জন্য অপরিসীম সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। জোনাকির জিনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা স্ট্রিটলাইট, বাড়ির বাতি, এমনকি গাড়ির হেডল্যাম্প তৈরির কথা ভাবছেন যা নিজেরাই আলো তৈরি করতে পারবে। এই ধরনের উদ্ভাবন বিদ্যুতের উপর নির্ভরতা কমিয়ে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
জোনাকির জিনের প্রয়োগ শুধু টেকসই আলোতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। বায়োমেডিসিনের ক্ষেত্রেও এর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। লুসিফেরেজ, জোনাকির আলো নিঃসরণকারী রাসায়নিক, ইতোমধ্যেই কিছু মেডিকেল ইমেজিং পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষকরা এখন জোনাকির জিনগুলোর পরিবর্তন সাধিয়ে আরও উজ্জ্বল এবং লক্ষ্য-নির্ধারিত বায়োলুমিনেসেন্ট মার্কার তৈরি করতে পারবেন, যা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটাবে। ক্যানসারের কোষ সনাক্তকরণে বা বিশেষ কোনো প্রোটিনের অবস্থান চিহ্নিতকরণে এই প্রযুক্তি অমূল্য হয়ে উঠতে পারে।
প্রকৃতির অনুপ্রেরণা, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ:
ঐতিহ্যবাহী বাতিগুলো বিপুল পরিমাণ শক্তি খরচ করে এবং পরিবেশ দূষিত করে। জোনাকির আলো সম্পূর্ণই পরিবেশবান্ধব। এটি কোনো বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় না এবং কোনো তাপ উৎপন্ন করে না। জোনাকির জিনগুলোর সাহায্যে তৈরি আলোর উৎসগুলি ঐতিহ্যবাহী বাতিগুলোর চেয়ে অনেক কম খরচে তৈরি করা যাবে এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে। এটি বিশেষ করে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রামীণ জনগণের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করবে, যেখানে এখনও বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়ন্ত্রিত।
যাইহোক, গবেষকরা জিনগত পরিবর্তনের নৈতিক দিকটি নিয়েও সতর্ক। অন্যান্য প্রাণীতে জোনাকি জিন প্রবেশ করানোর ফলে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে। যেকোনো বায়োলুমিনেসেন্ট প্রযুক্তি উন্নয়নে সতর্কতার সাথে যাচাই-বাছাই এবং দায়িত্বশীল বিকাশ অত্যন্ত জরুরী।
জোনাকির রহস্য উন্মোচন মৌলিক গবেষণার শক্তি ও গুরুত্বের স্মারক। এটি দেখায় যে, কতটা ক্ষুদ্র একটি প্রাণী বিশ্ব বদলানো আবিষ্কারের দ্বার খুলে দিতে পারে। আজ রাতে যখন আকাশে জোনাকিরা আলো ছড়াবে, তখন মনে রাখবেন, এই ক্ষুদ্র প্রাণী আর শুধু কবিতার বিষয় বা সন্ধ্যার শোভা নয়, ভবিষ্যতের উজ্জ্বল আলোর পথিকৃৎ।