দেউলিয়া লেবাননের ভবিষ্যৎ কী?

 

Lebanon

লেবানন ছিল উন্নয়নশীল দেশ। দেশটি পর্যটন খাতে বেশ এগিয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। কিছু দিন আগেও তাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে বলে জানতাম আমরা। কিন্তু দেশটি এমনভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে এমনটা আমাদের মনেই হয় নি। হঠাৎ জানলাম যে, দেশটিতে জ্বালানি ও খাদ্য সংকট বেড়ে গেছে। তারপরই খবর এলো যে, লেবাননকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছে।


বিভিন্ন ব্যক্তি বা কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষিত হলে সেই ব্যক্তির সমাজে কোন দাম থাকে না। দেনা পাওনার হিসেবগুলো পাল্টে যায়। ফতুর হয়ে যায় তারা। তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে পাওনাদারদের মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টন করা হয়। একটি দেশ দেউলিয়া হয়েছে তার ক্ষেত্রে কী ঘটবে? এমন আরো কিছু প্রশ্নের জন্ম হতে থাকে আমাদের মনে।


দেউলিয়া ঘোষণা

স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল আলজাদিদকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লেবাননের উপপ্রধানমন্ত্রী সাদেহ আল-সামি ঘোষণা দেন যে, লেবানন রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও দেউলিয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এখন জনগণের ক্ষতির মাত্রা কমাতে চাই। গত এপ্রিল ২০২২ তিনি এই ঘোষণা দেন। এরপর সারা বিশ্বে এই বেদনাদায়ক খবরটি ছড়িয়ে পড়ে।

উপপ্রধানমন্ত্রী আল-সামি আরো  বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিউপেক্ষা করার মতো নয় তাই লেবাননের ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন বন্ধ রাখা হবে।

দেউলিয়ার পর যে লোকসানের হিসাব তার পরিমাণ বুঝে রাষ্ট্র, কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাবিদার বা আমানতকারীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। তবে ভাগ-বাটোয়ারা কত শতাংশ হারে হবে তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। নিশ্চয়ই সেই হার হবে হতাশাজনক।


দেউলিয়া ঘোষণার পর কী হচ্ছে সেখানে?

সংগত কারণেই সেখানে হাহাকার বেড়ে গেছে। বিনিয়োগকৃত টাকা ব্যাংক থেকে উঠানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা চলছে অনেক ক্ষেত্রেই।

লেবানিজ জনগণ নিজেদের এখন দরিদ্র নয় ভিক্ষুক ভাবছে। কারণ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষিত।

দেউলিয়া ঘোষণার পর সামাজিক অস্থিরতা বাড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই ছিল আকাশ ছোঁয়া। এখন তারা আরো দাম বাড়লে কী করবে সেই দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছে।

বিদেশি ত্রাণের দিকে তাকিয়ে থাকার মত অবস্থা হয়েছে। হয়ত অপেক্ষা সেটারই। তা নাহলে দুর্ভিক্ষে মানুষ হয়ত মরেই যাবে সেখানকার।

 

দেউলিয়া হলে কী হয়?

কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন পাওনাদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয় তখন উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া হিসেবে দেখা হয়। আইন অনুসারে আদালত ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া বলে ঘোষণা করেন।

সাধারণত ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান এই দুই ধরনের সত্ত্বাকে আইনগতভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়ে থাকে। এই দুই ধরনের সত্ত্বার দেউলিয়ত্বের জন্য বিভিন্ন দেশে আলাদা আলাদা আইনের ব্যবস্থা রয়েছে।

ইতালীয় শব্দ Banca rotta থেকে এসেছে ইংরেজি Bankruptcy এর অর্থ ভাঙ্গা বেঞ্চ। প্রাচীনকালে বিনিয়োগকারী, অর্থলগ্নিকারী অর্থ বিনিময়কারীরা ভেনিসের শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে বেঞ্চ পেতে বসতেন এবং মানুষকে সুদে টাকা ধার দিতেন অথবা তাদের বৈদেশিক মুদ্রা পরিবর্তন করে দিতেন। আধুনিক কালের শব্দ ব্যাংক এর উৎপত্তিও হয়েছে ইতালীয় বেঞ্চ থেকে। 

ধারণা করা হয়, কোন অর্থ বিনিময়কারী যদি তার দেনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হত তবে তার বেঞ্চটি ভেঙ্গে ফেলা হত। তাই দেউলিয়া এই শব্দটি ব্যবহৃত হত। এমনও হতে পারে যে কোন বিশেষ অর্থ ছাড়াই শব্দটি শুধুমাত্র লোকমুখেই প্রচলিত হয়েছিল। দেউলিয়া শব্দটি শুনতে যেমনই হোক সেটি মোটেও সুখকর কিছু বয়ে আনে না।

লেবাননকে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক দেউলিয়াত্বের কাতারে ফেলতে পারি।

 

লেবানন কীভাবে দেউলিয়া হয়ে গেল?

দেউলিয়া হবার অপ্রতিরোধ্য স্রোতে লেবানন আরো আগেই পড়ে গিয়েছিল। দেশের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছিল। খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো অধরা হয়ে যায় তাদের কাছে। জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ ব্যবস্থায়ও ধস নেমেছিল।

আনাদোলু এজেন্সির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিভিন্ন সংকটের কারণে লেবাননের মুদ্রার মান ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পড়ে গেছে। ফলে জনগণের দৈনন্দিন সাধারণ চাহিদাগুলোও পূরণ হচ্ছে না। 

মৌলিক চাহিদা মেটানোর উপকরণগুলো অধরা হয়ে গেছে। জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা প্রায় অচল। কারখানা উৎপাদন ব্যহত হওয়ায় আয়-ব্যয়ে ভয়াবহ রকমের হেরফের হয়।

২০১৯ সালের নভেম্বর থেকেই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে লেবানন। যার মধ্যে ছিল মুদ্রার চরম অবমূল্যায়ন এবং জ্বালানি চিকিৎসা সেবায় ঘাটতি।

মধ্য ১৮শশতকের পর বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক আর্থিক সংকট বলে অভিহিত করে বিশ্বব্যাংক।

বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণ করোনাভাইরাসের ধাক্কায়  অর্থনৈতিক মন্দা তীব্রতর হয়।

ডেইলি সাবাহ জানায়, দেউলিয়াত্বের ঘোষণা আসার আগে প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ বেকার। ৮২ শতাংশ মানুষের অবস্থান দারিদ্যসীমার নিচে।

তারল্য সংকট দুর্নীতির পাশাপাশি সাম্প্রতিক ঘটনাবলী মুদ্রার পতন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ব্যাপক ঘাটতি, উচ্চ বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য এই ঘটনার দিকে ধাবিত করে।

ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে পারা যাচ্ছিল না।

 আইএমএফের সাথে দেনদরবার করে কোন লাভ পাননি দেশটির নেতৃত্ব।

 

লেবাননের ভবিষ্যৎ কেমন হবে?

দেউলিয়া ঘোষণার পর লেবানন দেশটির ভবিষ্যৎ কেমন হবে সেটা নিয়ে মানুষের জল্পনার শেষ নেই। দেশটির  উপ-প্রধানমন্ত্রী বলেছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তার কথা থেকে যে অর্থ পাওয়া যায় তা হলো- শুধু অর্থব্যবস্থার পুনর্বণ্টন হলো।

আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি কী পরিকল্পনা করছে তার ওপর নির্ভর করবে অনেক কিছু। তবে পার্শ্ববর্তী ধনী দেশগুলোরও কিছু করণীয় রয়েছে।

আমাদের ধারণা, একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন সেখানে আসতে যাচ্ছে। খাদ্য-পানীয়-জ্বালানি সংকটের সাথে সাথে রাজনৈতিক সংকট মানুষের ভোগান্তি কমাবে নাকি বাড়াবে তা অনুমেয়।

ভবিষ্যতে সতর্ক হবে তারা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশি সোচ্চার হবে লেবানিজরা।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অস্বীকার করেছেন

লেবাননের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর রিয়াদ সালামেহ দেউলিয়া হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। 

"কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার বিষয়ে যা প্রচার করা হচ্ছে তা ভুল," মিঃ সালামেহ দ্য ন্যাশনাল কে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেছেন।


লেবাননের পরিচয়

লেবানন শব্দের অর্থতুষার শুভ্র’ এটি পশ্চিম এশিয়ার একটি আরব রাষ্ট্র। দেশটির সরকারি ভাষা আরবি কারণ দেশটির ৯০%-এরও বেশি লোক আরবি ভাষায় কথা বলে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য সেখানে ফরাসি ভাষা ব্যবহার করা হয়। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার পাশাপাশি দেশটি আরব লীগ, জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন, ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা এবং অর্গানাইজেশন ইন্টারন্যাশনালে দে লা ফ্রাঙ্কোফোনির সদস্য। লেবানন প্রায় ৭০ লাখ জনসংখ্যার আবাস্থল এবং এর আয়তন ১০,৪৫২ বর্গকিলোমিটার এলাকা

লেবাননে সভ্যতার প্রাচীনতম প্রমাণের বয়স ৭০০০ বছরেরও বেশি সময় পুরনো। আধুনিক লেবানন ফিনিশিয়ানদের আবাসস্থল ছিল, এটি একটি সামুদ্রিক সংস্কৃতি যা প্রায় ৩০০০ বছর  পর্যন্ত সমৃদ্ধি লাভ করেছিল।

একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ লেবানন- যেখানে সরকারের শীর্ষ পদগুলো আনুপাতিক হারে নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধির জন্য নির্ধারিত। সংবিধান অনুসারে বছর পরপর সংসদীয় নির্বাচন হয়। আইনসভা বছর মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। 

পড়ুন: এলএনজি রপ্তানি কমিয়ে দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া

লেবাননের শেষ সংসদীয় নির্বাচন ২০০৯ সালে এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়। খ্রিস্টান রাষ্ট্রপতি আইনসভা একত্রে সুন্নি মুসলিম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন। সংসদের স্পিকার হন একজন শিয়া মুসলিম।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form